‘সবুজের ছোঁয়াতে বেঁচে থাকে প্রাণ
ফুল ফোটে পাখি গায় মাঠে হাসে ধান
সবুজ বাঁচাতে চাই সবুজ মন
সবুজে সবুজে এসো সাজাই জীবন’
সবুজই প্রাণের স্পন্দন। বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। সবুজ মানেই প্রকৃতি। প্রকৃতি মানেই প্রাণ। প্রকৃতি না থাকলে মানুষ থাকবে না। মানুষকে তাই প্রকৃতির সন্তান বলা হয়। প্রকৃতি মানুষকে শেখায়। চলতে-ফিরতে- বেঁচে থাকতে। জন্মের পর থেকে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে মানুষের। খাবার জোগায় প্রকৃতি, কাপড় জোগায় প্রকৃতি, রোগে ওষুধ দেয় প্রকৃতি, শোকে সান্ত্বনা দেয় প্রকৃতি, মাথা গোঁজার ঠাঁই দেয় প্রকৃতি, উৎসাহ দেয় প্রকৃতি, প্রশান্তি দেয় প্রকৃতি…। জন্ম থেকে মৃত্যু- প্রকৃতির সঙ্গ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রকৃতি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। যদি প্রকৃতি ছাড়া প্রাণ না বাঁচে তাহলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কেন এত বৈরিতা? সব মানুষই কি প্রকৃতির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করে? সবাই করে না, কেউ কেউ করে। এখন জানা দরকার কেউ কেউ কেন করে? উত্তর হল- নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সুখের জন্য কেউ ঘর বাঁধছে, ঘরের নকশায় একটা আমগাছ বেঁধে গেল। কোনোকিছু চিন্তা না করে কর্তাব্যক্তি গাছটাকে কেটে ফেলবে। গাঁয়ের কিংবা শহরের রাস্তা চওড়া করতে হবে। রাস্তার পাশে একটা বড় গাছ আছে। গাছটা কাটা পড়বে। শহরের গা ঘেঁষে আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠবে সেখানকার নদী-খাল ভরাট করা হবে, গাছ কাটা হবে, ঝোপ-জঙ্গল উজাড় হবে। স্কুল, কলেজ কিংবা হাসপাতাল গড়ে উঠবে আশপাশের প্রকৃতি ধ্বংস করা হবে। নদীতে ব্রিজ হবে, নদীকে শাসন নয়, শোষণ করা হবে। আমাদের চারদিকে তাকালেই চোখে পড়ে অর্থ লিপ্সার কারণে কেউ নদীদখল ও দূষণ করছে, পুকুর ভরাট করছে, বন উজাড় করছে, কল-কারখানা থেকে কার্বণ নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলছে, ইটভাটা করছে। এ মানুষদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আবার অনেকে প্রকৃতিকে নিরাপদ রাখার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। তারা গাছ লাগাচ্ছে, মানুষকে গাছ লাগাতে উৎসাহ দিচ্ছে, সচেতনতামূলক কর্মশালা করছে, বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছে, নদী দূষণের প্রতিবাদ করছে, সাগর সৈকত পরিষ্কার করছে, গাছ কাটতে বাধা দিচ্ছে, দূষিত পানি পরিশোধনে ইটিপি ব্যবহার করছে, ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলছে। পরিবারকে গড়ে তুলছে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের মন্ত্র দিয়ে। আবার কেউ কেউ আছে পরিবেশ প্রকৃতি ভালো থাকল কী মন্দ থাকল তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। গাছ কাটলে কিংবা বন উজাড় হলেও তাদের কিছু এসে-যায় না। দখল করা বা ভরে যাওয়া নদী উদ্ধারেও তাদের মন উৎফুল্ল হয় না। এরা প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। ভালো-মন্দ না বুঝে চোখ বুজে দিন-রাত কাটিয়ে দিতে চান। আসলে এরা প্রকৃতি সম্পর্কে অসচেতন।
দুই তিন যুগ আগেও আমাদের প্রকৃতি পরিপাটি ছিল। সবুজে ভরা ছিল চারপাশ। মাঠে মাঠে দেশি ধানের জাত, পাট, রবিশস্যের সেকি বাহার! গাছে গাছে ফুল-ফলের কোনো কমতি ছিল না। কী শহর কী গ্রাম। নদীগুলো ছিল স্বচ্ছ পানির ধারা। মানুষ সময় কাটাতে নদীর কাছে যেত। ছোট-বড় শহরগুলোতে সবুজের কোনো কমতি ছিল না। সবুজের আড়ালে ছিল অট্টালিকা। বাতাস ছিল নির্মল। প্রকৃতিতে ছিল সজীবতা। চারপাশ ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা। সন্ধ্যা নামলেই পাখির কলতানে মুখর হয়ে উঠত চারপাশ। আবার ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখির কিচিরমিচির। শিয়াল, বাগডাশ, বনবিড়াল, সাপ, ব্যাঙ, ডাহুক, দোয়েল, কোকিল, লতা, পাতা, ফুল সব জড়াজড়ি করে থাকত বাড়ির পাশের বাগানগুলোতে। বিলঝিলে ছিল জলজ উদ্ভিদের বাহার। দেশি মাছ ছাড়া বিদেশি মাছ তো চোখেই পড়ত না। কী স্বাদ আর ঘ্রাণ ছিল দেশি মাছে, আহা!
এখন আর আগের মতো ঢেউ খেলানো গাঢ় সবুজ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাহাড় যাচ্ছে মানুষের আহারে। পাহাড়ের গায়ে বেড়েছে মানববসতি। পাহাড়ের মাটি যাচ্ছে কখনও ইটভাটায় কখনও আবাসন প্রকল্প উন্নয়নে। পাহাড়ি বন কাটা পড়ছে। পাচার হচ্ছে বনের কাঠ। বনাঞ্চল দখল করে নিচ্ছে মানুষ। বন্যপ্রাণী চলাচল করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে। ফলে বাড়ছে মানুষ আর বন্যপ্রাণীর সংঘাত। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে ‘লোকালয়ে বাঘ’ ‘বন্যহাতির আক্রমণে প্রাণহানি’ ইত্যাদি শিরোনামের খবর। নদীকে গিলে খাচ্ছে মানুষ। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সবুজে মোড়ানো গ্রামগুলো রূপ নিচ্ছে শহরতলিতে। বন-বনানীতে নেই বন্যপ্রাণীর হম্বিতম্বি। বিস্তৃতি ঘটছে শহরের আর প্রকৃতির স্নিগ্ধতা-সজীবতা বিদায় নিচ্ছে। প্রাণপ্রাচুর্যেও শুরু হয়েছে ক্ষয়। কোনদিকে এগোচ্ছে আমাদের সোনার বাংলা, রূপসী বাংলা?
বৈরী জলবায়ুর স্পষ্ট ক্ষত এখন বাংলাদেশের বুকে। উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে। বারবার আঘাত হানছে আইলা, সিডর। আমাদের অহঙ্কারের ধন সুন্দরবন বুক পেতে বিপর্যয়ের আঘাত সহ্য করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। ঋতুবৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে প্রাণিকুল। আবার কখনও শীতের কামড়ে দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হচ্ছে। ফাগুন আর হেমন্তের দেখা পাওয়াই ভার। কখনও আবার অকাল অবিরাম বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা কিংবা বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রা ওঠানামার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোথাও কোথাও লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে প্রাণবৈচিত্র্য হুমকিতে রয়েছে।
দেশের এ পরিণতির জন্য আমরা দায়ী। আমরাই দায়ী। দায়ী আমাদের অপরিকল্পিত পরিকল্পনা। দায়ী আমাদের সভ্যতা। দায়ী আমাদের স্বার্থপরতা, অসচেতনতা, অর্থ লিপ্সা। আজ প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে উঠেছে আমাদের বিদ্বেষী ভাব। আমরা শহরের কলেবর বৃদ্ধি করেছি প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে। ইটের পর ইট গেঁথে শুধু দালান-কোঠাই নির্মাণ করেছি। প্রকৃতির স্থান কোথায় হবে তা কখনও ভেবে দেখছি না। শহরে আজকাল বুক ভরে নির্মল বাতাস নেয়ার একটু জায়গা নেই। বাড়িতে উঠান নেই, গাছ নেই। ছায়া নেই, ছায়ার মায়া নেই। শেষ কবে পায়ে কাদা মেখেছিল মনে পড়ে না। বায়ুদূষণের কারণে বারবার তালিকাতে চলছে আসছে রাজধানী শহর ঢাকা। শব্দদূষণ তো তীব্র আকার ধারণ করছে। এর পরিণাম যে কী ভয়াবহ তা শুধু ভবিতব্যই বলতে পারে।
বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও প্রকৃতির সম্ভারে সমৃদ্ধ। মলিনতার কালি এখনও সচেতনতার ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যায়। আর তা করতে হলে সবার আগে দরকার তৃণমূলে সচেতনতা, মানুষের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলা। মানুষকে বোঝাতে হবে প্রকৃতির অপার দানের মহিমা। প্রকৃতি আমাদের মায়ের মতো কোলে-পিঠে করে লালন-পালন করছে আর তার প্রতিদানে আমরা বিষ দিয়ে মাকে হত্যা করে চলেছি। মাটিকে করে তুলছি বন্ধ্যা। নদীকে করে তুলছি বর্জ্যরে ভাগাড়। বাতাস করে তুলছি বিষাক্ত।
সবার বোধোদয়ের জায়গাটা সজাগ করে তুলতে হবে। সবার বুকের ভেতর প্রকৃতি সংরক্ষণের বীজ বুনে দিতে হবে, তবেই ভালো থাকবে আমাদের দেশ, ভালো থাকবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।